বিদেশি শব্দ
বিদেশী শব্দ: ভারতবর্ষের বাইরের দেশ থেকে অথবা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ থেকে যে-সকল শব্দ স্ব-রূপে বা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপে বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলিকে বিদেশী শব্দ বলে। আগন্তুক শব্দগুলির মধ্যে বহির্ভারতীয় ইংরেজি, আরবি, ফারসি ও পর্তুগিজ শব্দই সংখ্যায় বেশি; আর, অন্তর্ভারতীয় প্রতিবেশী শব্দাবলীর মধ্যে হিন্দির আধিকাই উল্লেখনীয়।
ত্রয়োদশ শতকের প্রথমদিকে বঙ্গদেশ তুর্কি-কবলিত হওয়ার পর থেকে ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশলাভকরতে থাকে। বঙ্গদেশ আকবরের শাসনে আসবার পর থেকে বাংলায় ফারসি শব্দের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটল। মঙ্গলকাব্যগুলিতে, এমনকি ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদেও ফারসির ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। ফারসির দৌলতে অসংখ্য আরবি শব্দও বাংলা ভাষায় এসে পড়ল। ষোড়শ শতাব্দী থেকে এদেশে বাণিজ্যরত পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিদেরও বহু শব্দ বাংলায় এসেছে। আবার, দীর্ঘদিন ইংরেজ-শাসনাধীনে থাকার ফলে বহু ইংরেজি শব্দ স্ব-রূপে বা ঈষৎ বিকৃতরূপে আমাদের মাতৃভাষার ভাণ্ডারে প্রবেশলাভ করে বাংলাকে পরিপুষ্ট করে তুলেছে এবং এখনও তুলছে। বাংলা ভাষা আপন স্বীকরণক্ষমতার বলে এইসমস্ত বিদেশী শব্দকে এমন আশ্চর্যজনকভাবে আপন করে নিয়েছে যে, এরা যে আদৌ বিদেশী, বেশ সচেতন না হওয়া পর্যন্ত সেটা বুঝতেই পারা যায় না। অতি-পরিচিত বিদেশী শব্দগুলির একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়া হল—
- আরবি:— আকছার, আক্কেল, আজব, আতর, আদব, আদায়, আদালত, আমলা, আমানত, আমির, আয়েশ, আলবত, আলাদা, আল্লা, আসবাব, আসর, আসল, আসামি, আস্তাবল, আহাম্মক, ইজারা, ইজ্জত, ইমান, ইমারত, ইশারা, ইসলাম, ইস্তফা, ইহুদি, ইদ, উকিল, উজির, এখতিয়ার, এজলাস, এলাকা, ওকালতি, ওজন, ওমরাহ, ওরফে, কড়ার, কদম, কদর, কবজা, কলপ, কলম, কসরত, কসাই, কসুর, কাজী, কানুন, কামিজ, কায়দা, কায়েম, কালিয়া, কাহিল, কুলুপ, কেতা (কায়দা), কেল্লা, কৈফিয়ত, খতম, খবর, খসড়া, খাজনা, খাতির, খারাপ, খারিজ, খালাস, খালাসি, খালি, খাস, খাসা, খাসি, খুন, খেয়াল, খেলাপ, খেসারত, খোলসা, গজল, গরজ, গরমিল, গরিব, গলদ, গাফিলতি, গোলাম, ছবি, জবাব, জব্দ, জমা, জমায়ত, জলদি, জলসা, জলুস, জল্লাদ, জহর, জহরত, জাফরান, জামিন, জারি, জালিয়াতি, জাহাজ, জিনিস, জিম্মা, জুলুম, জেরা, জেলা, তছরুপ, তদারক, তফাত, তবলা, তলব, তল্লাশ, তাগাদা, তাজ্জব, তামাশা, তারিখ, তালাক, তালিকা, তালিম, তাস, তুফান, তুলকালাম, তোফা, তোয়াক্কা, তোয়াজ, দখল, দপ্তর, দফা, দলিল, দাখিল, দুনিয়া, দোয়াত, দৌলত, নকশা, নগদ, নবাব, নাগাদ, নাজেহাল, নায়েব, নেশা, ফকির, ফতুয়া, ফতুর, ফয়সালা, ফসল, ফানুস, ফারাক, ফি, ফিরিস্তি, ফুরসত, ফেরার, ফোয়ারা, ফৌজ, বদল, বহাল, বাজে, বাতিল, বাদ, বিদায়, বিলকুল, বিলাত বিলায়ৎ, বিসমিল্লা, মকদ্দমা, মক্কেল, মজবুত, মজলিশ, মজুত, মঞ্জুর, মনিব, মফস্বল,মশগুল, মসজিদ, মসনদ, মশলা, মহকুমা, মহরম, মহল, মানে, মাফ, মারফত, মালিক, মালুম, মাশুল, মিছরি, মিছিল, মুনশি, মুনাফা, মুরুবিব, মুলুক, মুশকিল, মুসলিম, মুসাফির, মেজাজ, মেরামত, মোকাবিলা, মোক্তার, মোক্ষম, মোতায়েন, মোলায়েম, মৌরসি, রকম, রাজী, রায়, রেওয়াজ, শখ, শরবত, শরবতি, শর্ত, শহিদ, শামিল, শুরু, শৌখিন, সদর, সফর, সহিস, সাফ, সাবেক, সাহেব, সেলাম, হক, হজম, হজরত, হদিশ, হয়রান, হলফ, হাওয়া, হাকিম, হাজত, হাজির, হামলা, হাল, হালুইকর, হালুয়া, হিম্মত, হিসাব, হুকুম, হজুর, হেপাজত।
- ফারসি:—অজুহাত, অন্দর, আইন, আওয়াজ, আঙুল, আন্দাজ, আপশোস, আবরু, আবহাওয়া, আবাদ, আমদানি, আমেজ, আয়না, আরাম, আশরফি, আশমান, আস্তানা, আস্তে, ইরান, ইসবগুল, ওস্তাদ, কম, কাগজ, কামাই, কামান, কারখানা, কারবার, কারিগর, কিনারা, কিশমিশ, কুস্তি, কোমর, খঞ্জর, খরগোশ, খরচ, খরিদ, থাকি, খানসামা, খাম, খুব, খুশি, খোরাক, খোশামোদ, গজ, গরম, গর্দান, গুজরান, গুম, গুল (ফুল), গোমস্তা, গোয়েন্দা, গোলাপ, গ্রেফতার, চরকা, চরকি, চশমা, চাকর, চাকরি, চাকরান, চাদর, চাঁদা, চাবুক, চালাক, চেহারা, জখম, জমি, জরি, জাদু, ও নোয়ার, জামা, জোয়ান, জোর, তরকারি, তরমুজ, তাজা, তীর (শর), তীরন্দাজ, তৈয়ার, দরকার, দরখাস্ত, দরজা, দরদ, দরবার, দরবেশ, দরাজ, দরুন, দস্তখত, দস্তানা, দহরম, দাগ, দান, দাবি, দামামা, দারোয়ান, দালান, দিলখোশ, দিস্তা, দূরবিন, দেওয়াল, দেরি, দোকান, দোস্ত, নমাজ, নমুনা, নরম, নাচার, নাবালক, নামজাদা, নালিশ, নাশপাতি, নাস্তানাবুদ, নিমক, নিমকি, নিশান, পছন্দ, পয়গম্বর, পরদা, পরগনা, পরী, পরোয়া, পরদা, পলক, পশম, পাঁজা, পাজি, পায়জামা (পাজামা), পায়রা, পালোয়ান, পেয়াদা, পেয়ালা, পেশা, পেস্তা, পোক্ত, পোলাও, পোশাক, পোস্তা, ফরমান, ফরমাশ, ফরিয়াদি বকশিশ, বজায়, বজ্জাত, বদ, বদন (শরীর: গুলবদন-পুষ্পতনু), বনিয়াদ, বন্দর, বন্দুক, বরখাস্ত, বরদাস্ত, বরফ, বরাদ্দ, বরাবর, বস্তা, বাগ, বাগিচা, বাজার, বাজি, বাজিকর, বাদশাহ্, বাদাম, বারান্দা, বাহাল, বিমা, বেকার, বেচারা, বেদম, বেদানা, বেপরোয়া, বেবন্দোবস্ত, বেশ, বেশরম, বেশি, বেংশ, মগজ, মজুমদার, মজুর, ময়দা, ময়দান, মরিচা, মালাই, মালিশ, মাহিনা, মিহি, মেথর, মোজা, মোম, মোরগ, মোহর, রঙ্গিন, রপ্তানি, রসদ, রসিদ, রাস্তা, রুমাল, রেশম, রোজ, রোজগার, লাগাম, লাশ, লেফাফা, শরম, শরিক, শহর, শামিয়ানা, শাল, শালগম, শিকার, শিরনি, শিশি, শের (বাঘ, সিংহ), শোরগোল, সওদাগর, সফেদা, সবজি, সবুজ, সরকার, সরগরম, সরজমিন, সরঞ্জাম, সরাসরি, সরোদ, সর্দি, সাজা, সাদা, সানাই, সাল, সিপাহি, সুদ, সুপারিশ, সে (তিন), সেতার, সেরা, সেরেস্তা, হপ্তা, হরদম, হাঙ্গামা, হাজার, হামেশা, হিন্দু, হিন্দি, হিন্দু, হুঁশ, হুঁশিয়ার, হেস্তনেস্ত।
- আরবি-ফারসির মিশ্রণ:— আদমশুমার, ওকালতনামা, কুচকাওয়াজ, কেতাদুরস্ত, কোহিনুর, খবরদার, খয়েরখী, খামখেয়াল, জমাদার, জরিমানা, ত-খরচ, না-মঞ্জুর, না-রাজ, নেক-নজর, পিলসুজ, পোদ্দার, বকলম, বরকন্দাজ, বেআইন, বেআক্কেল, বেআদব, বেইজ্জত, বেইমান, বে-এক্তিয়ার, বে-ওজর, বে-ওয়ারিশ, বেকসুর, বেকায়দা, বেকুফ, বেজায়, বেদখল, বেমালুম, বেহদ্দ, বেহায়া, বেহিসাবী, হকদার, হুঁকাবরদার [আরবি-ফারসি শব্দে প্রায় সর্বত্রই ত, কচিৎ ৎ (ত)-লক্ষ্য করো।
- তুর্কি:— কলকা, কাঁচি, কানাত, কাবু কুলি, কোর্মা, ক্রোক, খাঁ, চকমকি, চিক, তকমা, তোপ, দারোগা, বকশি, বাবুর্চি, বারুদ, বোঁচকা, কুঁচকি, বেগম, মুচলেকা।
- শিক্ষা-সংস্কৃতি-ধর্ম, সভ্যতা-ব্যবসায়বাণিজ্য-শিল্পকলা, শাসনকার্য-রাজস্ব-আইন-আদালত প্রভৃতি বিবিধ বিষয়-সংক্রান্ত এইসব আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দ আমাদের জীবনের সঙ্গে কেমন ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে, লক্ষ্য করো।
- ইংরেজি (মূল ইংরেজি শব্দ, এবং ইংরেজি নয় অথচ ইংরেজির সূত্রে আসা অন্য বিদেশী শব্দও): —অক্সিজেন, আপিস, আপেল, আরদালি (<orderly), আর্ট, আস্তাবল (stable), ইঞ্জিন, উল, এজেন্ট, কংগ্রেস, কনসার্ট, কনস্টেবল, কফি, কমা, করগেট, কর্ক, কাপ্তেন (<captain), কার্নিস, কার্পেট, কুইনিন, কুইন্টাল, কেক, কেটলি, কেরোসিন, কেস, কোকেন, কোম্পানি, কৌচ, কৌসিলী (<council), ক্যাম্বিস (<canvas), ক্যামেরা, খ্রিশ্চান (<Christian), ক্লাব, ক্লাস, গারদ (<guard), গার্জেন (<guardian), গেজেট, গেঞ্জি, গেট, গেলাস (<glass), চিমনি, চান্স, চেক, চেন, চেআর, জাঁদরেল (<general), জিরাফ, জুবিলি, জেব্রা, জেটি, জেল, জেলি, জ্যাকেট, টাইপ, টাইম, টিকিট, টিন, টিফিন, টেবিল (table), টেলিগ্রাম, টেলিফোন, ট্যাক্সি, ট্রাম, ট্রেন, ডক, ডজন, ডবল, ডাক্তার (<doctor), ডিপো (<depot), ডেপুটি, ড্রাম, ড্রেন, তোরঙ্গ (<trunk). থিয়েটার, নম্বর, নোটিস, পকেট, পাউডার, পানসি (<pinnace), পার্লামেন্ট, পার্সেল, পালিশ, পিয়ন, পিয়ানো, পুলিস, পেট্রল, পেন, পেনশন, পেনসিল, ফিট, ফোটোগ্রাফ, ফ্যাশন, ফ্রক, ফ্রেম, ফ্ল্যাট, বাক্স (<box), বারিক (<barrack), বার্লি, বিস্কুট, বুরুশ (<brush), বোনাস, মাইল, মার্কিন, মোটর, ম্যানেজার, রাবিশ, রিহার্সাল, রেস, লিলি, লেমোনেড, সনেট, সার্কাস, সার্জ, সার্জন, সিগন্যাল, সিল, সেমিকোলন, মো. প্লেট, স্নো, হাইকোর্ট, ছইল, হুক, হোমিওপ্যাথি।
- পর্তুগিজ:— আচার, আতা, আনারস, নোনা (এনোনা), আয়া, আলকাতরা, আলপিন, আলমারি, ইস্তিরি, ইস্পাত, কপি, কামরা, কেদারা, খানা (ডোবা), গরাদ, গামলা (<gambella), গির্জা, গুদাম, চাবি, জানালা, টোকা (পাতার তৈরি ছাতা), তামাক, তোয়ালে, নিলাম, পাঁউরুটি, পাদরি, পিপা, পিস্তল, পেঁপে, পেয়ারা, পেরেক (<prego), ফরাসি, ফিতা, ফিরিঙ্গি, বয়া, বরগা (<verga), বালতি, বেহালা, বোমা (<bomba), মাইরি (<Maria), মার্কা, মাজুল (<mastro), মিস্ত্রি, যীশু, সান্তারা (<cintra-কমলালেবু), সাবান, সায়া।
- ওলন্দাজ:— কার্তুজ, কুপন, রেনেসাঁস, রেস্তরা।
- জার্মান: ওলকপি (ইতালীয় থেকে নেওয়া), নাৎসী (Nazi), কিন্ডারগার্টেন।
- স্পেনীয়:— ডেঙ্গু (dengue)।
- ওলন্দাজি: ইশকাপন, তুরুপ, রুইতন, হরতন।
- গ্রীক: কেন্দ্র (<kentron শব্দটি গ্রীক থেকে সংস্কৃতে আসে), দাম (<drakhme), সুরঙ্গ (<syringx)। রাশিয়ান: ভডকা, বলশেভিক, স্পুটনিক।
- জাপানি: ইকেবানা, জুজুৎসু, টাইফুন, রিক্সা, হারাকিরি, হাসুনোহানা।
- চীনা: চা, লিচু ,চিনি।
- মালয়ী: কাকাতুয়া।
- সিংহলি: বেরিবেরি।
- বর্মী: লুঙ্গী।
- অস্ট্রেলেশীয় : ক্যাঙ্গারু।
No comments:
Post a Comment