বিশেষণের শ্রেণিবিভাগ ও প্রয়োগবৈচিত্র্য
যে পদ অন্য পদকে বিশেষিত করে অন্য পদের দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে তাকে বিশেষণ পদ বলে। 'শীতল জল' বললে 'জল'-এই বিশেষ্য পদের একটি বিশেষ অবস্থার কথা বলা হয়। সুতরাং শীতল' এই বিশেষ্য পদের বিশেষণ।
যে ধরনের পদের সঙ্গে প্রযুক্ত হয় তার বিচারে বিশেষণ মূলত দুই রকম: (১) নাম-বিশেষণ, (২) ক্রিয়া-বিশেষণ।
১) যে বিশেষণ বিশেষ্য, সর্বনাম ও বিশেষণ পদের সঙ্গে ব্যবহৃত হয় তাকে বলে নাম-বিশেষণ।
নাম- বিশেষণের শ্রেণীবিভাগ :
(ক) বিশেষ্যের বিশেষণ,
(খ) সর্বনামের বিশেষণ,
(গ) বিশেষণের বিশেষণ,
ঘ) সংখ্যা বিশেষণ
(ঙ) পূরণবাচক বিশেষণ,
(চ) সম্বন্ধ বিশেষণ।
এ ছাড়াও আরো দুটি বিশেষণ আছে , সেগুলি হল (ছ) ক্রিয়া-বিশেষণ ও (জ) বিধেয়-বিশেষণ
- বিশেষণের শ্রেণীবিভাগ
১) বিশেষ্যের বিশেষণ
২) সর্বনামের বিশেষণ
৩) বিশেষণের বিশেষণ
৪) সংখ্যা বিশেষণ
৫) পূরণবাচক বিশেষণ
৬) সর্বনামীয় বিশেষণ
৭) সম্বন্ধ বিশেষণ
৮) ক্রিয়া-বিশেষণ
বিশেষণের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা
১) বিশেষ্যের বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ বিশেষ্য পদ কে বিশেষিত করে অর্থাৎ তার দোষ, গুণ, অবস্থা প্রভৃতি প্রকাশ ইত্যাদি করে তাকে বিশেষ্যের বিশেষণ বলে। যথা: শীতল জল, ঠান্ডা হাওয়া, ভালো ছেলে, সুন্দর দৃশ্য, সুশ্রী বালিকা ইত্যাদি
২) সর্বনামের বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ সর্বনাম পদকে বিশেষিত করে তাকে সর্বনামের সর্বনামের বিশেষণ বলে
যথা: তুমি সুন্দর । মূর্খ আমি শাস্ত্রের কথা কী প্রকারে জানিব? সর্বনামের বিশেষণের বিশেষণ।
৩) বিশেষণের বিশেষণ: যে বিশেষণ পদে অন্য বিশেষণ পদের দোষ, গুণ, অবস্থাকে বিশেষভাবে বলা হয়, তাকে বিশেষণ বিশেষণ বলে 'খুব শীতল জল' বললে 'খুব' পদের দ্বারা শীতল অর্থাৎ ঠান্ডার ভাবটি যে অনেক বেশি এই কথাটি বিশেষভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং 'খুব' পদের 'শীতল' বিশেষণ পদের অব্যথাকে বিশেষিত করা। হয়েছে। তাই এই বাক্যের খুব' পদটি বিশেষণের বিশেষণ। অন্য উদাহরণ: অতি মনোরম দৃশ্য, অত্যন্ত সুস্বাদু খাদল, বেশ বড়ো মাছ ইত্যাদি।
৪) সংখ্যা বিশেষণ: যে বিশেষণে নামপদের সংখ্যা বা পরিমাণ বোঝায় তাকে বলে সংখ্যা বিশেষণ। যেমন: হাজার টাকা, দু-কিলো মাছ, পাঁচজন লোক, দু-বিঘা জমি, এক-গ্লাস জল।
৫) পূরণবাচক বিশেষণ : যে বিশেষণে নামপদের ক্রমবাচক রূপকে বোঝায় তাকে বলে পূরণবাচক বিশেষণ। যেমন: প্রথম দিন, দ্বিতীয় লোকটি, দোসরা শ্রাবণ, চৌঠা মাঘ, শততম জন্মজয়ন্তী। বাংলায় পূরণবাচক বিশেষণগুলি প্রধানত দুই শ্রেণির: (১) তদ্ভব: পয়লা, দোসরা, তেসরা, চৌঠা, পাঁচই/পাঁচুই, ছউই, সাতই/সাতুই, বিশে, একুশে পঁচিশে ইত্যাদি। (২) তৎসম : প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, বিংশ-বিংশতিতম, একবিংশ। একবিংশতিতম, পঞ্চবিংশ/পঞ্চবিংশতিতম ইত্যাদি। সাম্প্রতিককালে পূরণবাচক বিশেষণ গঠনে সাধারণ সংখ্যাবাচক শব্দের সঙ্গে 'তম' যোগ করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন: রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবর্ষ, বঙ্কিমের দেড়শোতম জন্মজয়ন্তী। এ ছাড়া, সাধারণ সংখ্যার সঙ্গে সম্বন্ধ বিভক্তি যুক্ত করেও পূরণবাচক বিশেষণ গঠন করা হয়। যথা: পাঁচের পৃষ্ঠায় লেখো; দশের পরিচ্ছেদ; পাঁচদিনের দিন।
৭) সম্বন্ধ বিশেষণ: যে বিশেষণ পদে নামপদের সঙ্গে বিশেষণ পদের সম্বন্ধ বোঝায় তাকে সম্বন্ধ বিশেষণ বলে। যেমন: গোরুর দুধ, বাপের বাড়ি, গরমের ছুটি, পুজোর জামা, ডিমের ডালনা।
৮) ক্রিয়া-বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ কোনো ক্রিয়া বা কাজকে বিশেষিত করে তাকে ক্রিয়া-বিশেষণ বলে। যেমন: রাম চলে-এই বাক্যে 'চলে' একটি ক্রিয়াপদ, কেন-না এর সাহায্যে রামের 'চলা' কাজটি বোঝাচ্ছে। কিন্তু 'রাম ধীরে চলে' বললে, 'ধীরে' পদের দ্বারা রাম কীভাবে চলে তা প্রকাশ করা হয়। সুতরাং 'ধীরে' পদটি ক্রিয়া-বিশেষণ। অন্য উদাহরণ: খর বায়ু বয় বেগে, দ্রুত চলো, তাড়াতাড়ি খাও, সে শীঘ্র আসিবে; দিনভর খেটে মাত্র দশটাকা রোজগার হয়েছে ইত্যাদি।
৯) বিধেয়-বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ বাক্যের বিধেয় অংশ বসে তাকে বিধেয়-বিশেষণ বলে। যেমন: পুলটি সুন্দর। মেয়েটি ফরসা।
বিশেষণের প্রকারভেদ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা
নাম-বিশেষণের শ্রেণিভেদ:
- (ক) বিশেষিত পদের প্রকৃতি অনুসারে
(১) বিশেষ্যের বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ বিশেষ্য পদকে বিশেষিত করে তাকে বিশেষ্যের বিশেষণ বলে। যেমন : লাল ফুল, ঠান্ডা জল, বড়ো গাছ, টাটকা মাছ, সুন্দরী বালিকা, হাজার টাকা, বারো মাস ইত্যাদি।
(২) সর্বনামের বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ সর্বনাম পদকে বিশেষিত করে তাকে বলে সর্বনামের বিশেষণ। যেমন : 'তুমি তো ব্রাক্স, তোমার তো জাতিচ্যুতির ভয় নাই।' 'জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ'। 'অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে চিরদিন'। 'মাতঃ মোরা ক্ষত্রনারী'।
(৩) বিশেষণের বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ অন্য বিশেষণ পদকে বিশেষিত করে তাকে বলে বিশেষণের বিশেষণ। যেমন: যে বড়ো ভালো লোক-এখানে 'ভালো' পদটি বিশেষ্য পদ 'লোক'-এর বিশেষণ, 'বড়ো' পদটি আবার বিশেষণ পদ 'ভালো-র বিশেষণ; কাজেই 'বড়ো' বিশেষণের বিশেষণ। 'লোকটার পরিচ্ছদ একটু মূল্যবান কিন্তু খুব পুরাতন'। আমি অতিশয় স্বার্থপর ও নিরতিশয় নির্বিবেক।'
- (খ) অর্থ অনুসারে
(১) অবস্থাবাচক বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ নামপদের অবস্থা প্রকাশ করে তাকে বলে অবস্থাবাচক বিশেষণ। যেমন: লাল ফুল; উজ্জ্বল আলো মোটা মানুষ; গরম দুধ; বাজে কথা; গ্রাম্য লোক; 'সশঙ্ক লঙ্কেশশুর স্মরিলা শক্ষরে': 'বিষমাখা বাক্যবাণে কান হ'ল কালা'। 'মেজো বউ মন্দ নয়'; 'তরুণী রমণী যত একত্র হইয়া'; 'আজ আমি সুখী নহি, আজ আমি জয়ী'; 'ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা', 'অন্ধকারে বন্ধ-করা খাঁচায়'; 'বৃষ্টি ভরে বায়ুভরে নুয়ে পড়ে বার বার আধফোটা কুমুদ-কমল'।
(২) সংখ্যাবাচক বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ সংখ্যা নির্দেশ করে তাকে বলে সংখ্যাবাচক বিশেষণ; যথা: ইস্কুল তো হয়েছে কুড়ি-পচিশ বছর'; 'পাঁচশো টাকা তিনি জমা রেখে তীর্থযাত্রা করেন; 'সাত বৎসর পরে মাসখানেক হল ফিরে এসেছিলেন'; 'সুদে-আসলে প্রায় সাড়ে-সাতশো টাকা হল'; 'ষোলোটা মিষ্টি কিন্তু গুনে নোব হ্যাঁ'।
(৩) মাত্রাবাচক বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ নামপদের মাত্রা নির্দেশ করে তাকে বলে মাত্রাবাচক বিশেষণ। যথা: গভীর জল; লম্বা ছুটি; চওড়া রাস্তা; সরু গলি; অনেক টাকা; প্রচুর বই; বিস্তর ঝামেলা।
(৪) পূরণবাচক বিশেষণ : যে বিশেষণ পদ ক্রমিক সংখ্যা নির্দেশ করে তাক বলে পূরণবাচক বিশেষণ। যেমন: আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। পয়লা ফাল্গুন মুকুলের বিয়ে। চৌঠা আশ্বিন আমি এখান থেকে রওনা হব। দোজ বর। সেজদাদা (দাদাদের মধ্যে তৃতীয়)। ন-মামা (মামাদের মধ্যে চতুর্থ)। ফুল-দি (দিদিদের মধ্যে পঞ্চম)। বইয়ের তেত্রিশের পৃষ্ঠায় 'দেনাপাওনা' গল্পটা আছে। 'পঁচিশে বৈশাখ চলেছে জন্মদিনের ধারাকে বহন করে মৃত্যুদিনের দিকে।
(৫) সর্বনামীয় বিশেষণ: সর্বনাম পদ দিয়ে গঠিত বিশেষণকে বলে সর্বনামীয় বিশেষণ। যেমন: মদীয় (= আমার) গৃহে আগামীকাল সকলের নিমন্ত্রণ। তম্মদীয় (= আমাদের) বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা খুব নিষ্ঠার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। ত্বদীয় (= তোমার) এই উপহার পরীক্ষায় সর্বোৎকৃষ্ট ফললাভের জন্য। যুগ্মদীয় (= তোমাদের) গ্রাম নদীর কোন দিকে অবস্থিত? তদীয় (= তার) অঙ্কন প্রতিভা বিস্ময়কর। আমি ভবদীয় (= আপনার) সেবকমাত্র। শিক্ষক মহাশয় অবসর গ্রহণের পর স্বীয় (= নিজের) সম্পত্তি বিদ্যালয়কে দান করলেন।
- (গ) গঠন অনুসারে
(১) একপদী বিশেষণ : একটিমাত্র দিয়ে বিশেষ্যকে বিশেষিত করলে তাকে একপদী বিশেষণ বলে; যেমন: কালো মেঘ: নরম মাটি; ভীষণ মূর্তি; গভীর জল। গরম দুধ। নন্দনকাননে ভ্রমে দুরাচার দৈত্য।
(২) বহুপদী বিশেষণ: অলোপ সমাসে সমসামান পদগুলির বিভক্তি লুপ্ত না হওয়ায় সমস্যমান পদগুলির মধ্যে অর্থের সম্পর্ক বজায় থাকে। এজন্য অলোপ সমাসের পদগুলি সমাসবদ্ধ হলেও এক হিসেবে বহুপদী। এই ধরনের বিশেষণকে বহুপদী বিশেষণ বলে। যেমন: সব পেয়েছির দেশে; সবার-পরশে-পবিত্রকরা তীর্থ নীরে; নকশিকাঁথার মাঠ (অলোপ সমাস নয়); আধমাইল লম্বা উটের সারি (অলোপ সমাস নয়)। হাতে একগাছি হরিণের শিঙের হাতল দেওয়া বেতের ছড়ি।
(৩) বাক্যাশ্রয়ী বিশেষণ: বাক্যের কোনো কোনো বাক্যাংশ বিশেষ্যকে বিশেষিত করলে তাকে বাক্যাশ্রয়ী বিশেষণ বলে। যেমন: সে অবস্থায় পিছনের দিকে তাকাতে পারেন এমন স্থিতপ্রজ্ঞ, এমন স্নায়ুবিহীন, দুঃখেজনুদ্বিগ্নমনা' স্থিতধী মুনিপ্রবর আমি দেখিনি। বিজয়ী বীর অর্জুন নহে-যে রাজ্য পাইল মান পাইল, রথের উপর হইতে বাণ ছুঁড়িয়া বিপন্ন শত্রুকে নাশ করিল। বিজয়ী কর্ণ-যে মানুষের চিরকালের চোখের জলে জাগিয়া রহিল, মানুষের বেদনায় অনুভূতিতে সহচর হইয়া বিরাজ করিল-সে। (পথের পাঁচালী)
(৪) ধ্বন্যাত্মক বিশেষণ: ধ্বন্যাত্মক শব্দ বিশেষ্যকে বিশেষিত করলে তাকে ধ্বন্যাত্মক বিশেষণ বলে। যথা: গনগনে আঁচ। টনটনে জ্ঞান। খুঁতখুঁতে স্বভাব। ফুরফুরে স্বভাব। ফুরফুরে হাওয়া। ছিপছিপে চেহারা। প্যানপেনে কান্না।
(৫) শব্দদ্বৈতাশ্রয়ী বিশেষণ: শব্দদ্বৈত বিশেষ্যকে বিশেষিত করলে তাকে শব্দদ্বৈতাশ্রয়ী বিশেষণ বলে। যথা:
next cooming soon
0 Comments