Header Ads

ভাবসম্প্রসারণ | ভাবসম্প্রসারণের নিয়ম | Bhabsamprosaran | বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি


ভাবসম্প্রসারণ

(নির্মিতি)

ভাবসম্প্রসারণ এবং তার উদ্দেশ্য

"ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ, 

রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া। 

অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ

 সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।”

 —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবি-সাহিত্যিকেরা তাঁদের বিচিত্র ভাবনা-কল্পনাকে যে দৃঢ়সংবদ্ধ বিশিষ্ট শিল্পমূর্তি দান করেন, তার অন্তর্নিহিত ভাবটিকে বিশদভাবে আলোচনা করার নাম ভাবসম্প্রসারণ। ভাবসম্প্রসারণ ও ভাবার্থ প্রায় সমজাতীয় হলেও উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। ভাবসম্প্রসারণে করা হয় মূল ভাবের বিস্তার আর ভাবার্থে করা হয় ভাবের সংহতি। অবশ্য উভয় ক্ষেত্রেই ভাবের রসঘন মূর্তিকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সরলীকৃত করে প্রকাশ করা হয়। যা ছিল উপমাদি অলংকারসমৃদ্ধ, বাকচাতুর্যমণ্ডিত শিল্পকৌশল, যার অর্থ ছিল ইগিতের পরোক্ষতায় নিগূঢ় বুদ্ধিগ্রাহ্য, তাকে সহজভাবে প্রকাশ করে, আকার-ইঞ্চিত-ব্যঞ্ছনার পরোক্ষতা মুক্ত করে বোধের সীমায় নিয়ে আসা ও ভাবের স্পষ্টতা দান করাই ভাবসম্প্রসারণের উদ্দেশ্য।

ভাবসম্প্রসারণের নিয়মাবলি—

● প্রদত্ত উদ্ধৃতিটির পরিপূর্ণ অর্থবোধের জন্য সেটি মনোযোগ সহকারে বার বার পাঠ করতে হবে।

● অর্থবোধ হলে সেই সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক কথাগুলিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। ভাবসম্প্রসারণের ভাষা হবে প্রাঞ্জল। পরিচ্ছন্ন চিত্তা, শব্দ এবং গতিশীল প্রকাশভঙ্গি হল ভাবসম্প্রসারণের আদর্শ রচনাশৈলী। সাধু বা চলিত যে-কোনো রীতিতেই তা লেখা গেলেও বর্তমানে চলিত রীতিই বাঞ্ছনীয়, তবে সাধু ও চলিত মিশে গিয়ে যাতে গুরুচণ্ডালি দোষ না হয়, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে।

● উদ্ধৃতিটির মূল উৎস নির্দেশ, লেখক বা কবির নামোল্লেখ সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়। উত্তমপুরুষের রচনারীতি ত্যাগ করতে হবে।

● অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে।

● যদি কোথাও মূল ভাবটি রূপকের অন্তরালে থাকে, তবে তার বাচ্যার্থ এবং নিহিতার্থ বা ব্যঞ্জনার্থ দুটি পৃথক অনুচ্ছেদে দিয়ে উপসংহারের মতো আর-একটি অনুচ্ছেদ করতে হবে। আর যদি ভাব থাকে তাহলে পৃথক অনুচ্ছেদ না হলেও চলবে, যদিও প্রয়োজনবোধে একাধিক অনুচ্ছেদও করা চলে।

● ভাবসম্প্রসারণের আয়তন সম্পর্কে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই।


ভাবসম্প্রসারণের নমুনা —১

নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস

ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। 

নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে

কহে যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে। 

 নদীর এপার ভাবে, অপর পারেই বুঝি সমস্ত সুখ এবং শাস্তি। আবার নদীর ওপারেও সেই একই চিত্র। দুঃখের দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ওপার ঘোষণা করে যে, যত কিছু মুখ, সবই এপারে। এইভাবে নদীর এক পার নিজের রিকতাকে একমাত্র সত্য বলে মনে করে অপর পারের কল্পিত সমৃদ্ধিতে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। আবার নদীর অপর পারের অন্তরের কথাটিও সেই অপরিতৃপ্তির হা-হুতাশে বেদনাবিষণ্ণ। নদীর এই দুই পারের অতৃপ্তির পাঁচালি দেন মানুষের জীবনেরই এক যথার্থ রূপ।

মানুষের বাসনা অন্তহীন। প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির দ্বৈত টানাপোড়েনে মানুষের মনে হয়, “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।" এই জন্যই সুখদুঃখ, সুযোগ-বঞ্চনা, ব্যর্থতা-প্রতিষ্ঠার চুলচেরা বিচারে, অন্যের সলো অহেতুক তুলনায় মানুষ নিজের মনের লোভরিপু ও অসন্তোষের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। সে ভাবে, অন্যের তুলনায় সে দৈন্য কতখানি, সামাজিক প্রতিষ্ঠায় তার ঘাটতির কী পরিমাণ। ফলে, তার নিজের যোগ্যতা, সামর্থ্য ইত্যাদির মাত্রা পরিমাপ করা তার বিকৃত বুদ্ধিতে সম্ভব হয় না। একধরনের হীনম্মন্যতায় সে তখন নিজের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। কিন্তু সূক্ষ্ম বিচারে দেখা যায়, পরিপূর্ণ মুখ বা পরিতৃপ্তি কারও অধিগত নয়। বাইরে থেকে দেখে যাকে পূর্ণ বলে মনে হয়, তার ভেতরেও হয়তো রয়েছে বিরাট শূন্যতা ও অভাববোধ। "They only prize what they no longer possess."

বস্তুত মানুষ অপরের মূল্যায়ন করার সময় নিজের অভাববোধটাকে বড়ো করে দেখে বলে অপরের অপূর্ণতা তার পক্ষপাতপূর্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর একটা ভালো দিকও চোখে পড়ে। তা হল, মানুষের এই অসন্তোষ মানুষকে অনেক সময় দুর্লভের সাধনায় প্রেরণা দিয়ে থাকে। তাই মানবসংসারের এই চিত্রটি একাধারে যেমন করুণ, তেমনি কৌতুককর।


ভাবসম্প্রসারনের নমুনা —২

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে

তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।

অথবা

ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা 

হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা 

তোমার আদেশে।

আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা আছে যে, ক্ষমা পরম ধর্ম, ক্ষমা মহতের গুণ। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই ধারণা সর্বত্র প্রযোজ্য নয়। সমাজে যারা পাপ, অন্যায়, অসৎকর্ম করে, অসহায় দুর্বলকে পীড়িত করে, তারা ক্ষমার অযোগ্য। তাদের প্রতি সহিষ্ণু হয়ে ক্ষমা প্রদর্শনের অর্থ তাদের অন্যায় কাজকে প্রশ্রয় দেওয়া। এরকম ক্ষমাগুণের দ্বারা মহত্ত্ব দেখানো হয় না, বরং ক্ষমা প্রদর্শনের ছলে নিজের দুর্বলতা ও ভীরুতাকে আবৃত করে আত্মপ্রতারণা করা হয়। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা লোভ ও লাভের নেশায় মেতে উঠে একের পর এক অন্যায় করে চলে।

বিধাতার বিশ্ববিধানে সে নিশ্চয়ই অপরাধী। কিছু আর এক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা চোখের সামনে সেই অন্যায় দেখেও প্রতিবাদ করে না বা প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। এইভাবে ভীরু, দুর্বলচেতা মানুষ হাস্যকরভাবে ক্ষমাগুণের মহত্ত্ব দেখিয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। ফলে অন্যায়কারী সমাজের বুকে অবাধে বিচরণ করতে পারে এবং তাদের অন্যায় ও অত্যাচার আরও তীব্র, আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তাই আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহাকারী উভয়েই সমান অপরাধী। যদি অন্যায়কারী দণ্ডনীয় হয়, তবে অন্যায়ের সমর্থনকারীও সমান সত্তাই। এরা উভয়েই বিশ্ববিধাতার ঘৃণার পাত্র। শুষ্ক তৃণখণ্ড যেমন অগ্নিতে দগ্ধ হয়, তেমনি বিশ্ববিধানকে লঙ্ঘন করার অপরাধে বিধাতাপুরুষের রুদ্র রোষানলে অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহাকারী উভয়েই দগ্ধ হয় কারণ অন্যায়কারী যদি হয় প্রত্যক্ষ অপরাধী, তাহলে অন্যায় সহাকারীও পরোক্ষ অপরাধী।

সুতরাং, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়া প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। সেজন্য ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই। কারণ যে অন্যায় করে সে নৈতিকভাবে দুর্বল। দৃঢ়চিত্তে যদি তাকে প্রতিরোধ করা যায়, তবে অচিরেই সে পর্যুদস্ত হবে।

No comments

Powered by Blogger.