অব্যয় পদ |
বাক্যে ব্যবহৃত শব্দকে পদ বলে। ব্যাকরণে পদকে প্রধানত পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। এই পাঁচভাগের এর ভাগের নাম হল অব্যয়। ‘অব্যয়' শব্দটির অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘যার ব্যয় বা পরিবর্তন নেই। অর্থাৎ যে পদ বাকে, ব্যবহৃত হয় অথচ নিজে পরিবর্তিত হয় না, সেই পদ হল অব্যয় পদ। অতএব বলা যায়— বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর মধ্যে এমন কিছু পদ আছে যেগুলোর কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যয় বা পরিবর্তন হয় না তাদের অব্যয় পদ বলে। যেমন- এ, এবং, কিন্তু, তবু, তথাপি, ছিঃ, মরি, তাই, তো, ইস ইত্যাদি। তোমরা পরীক্ষার খাতায় অব্যয়ের ধারণা সম্পর্কে লিখতে পার— বাক্যের মধ্যে লিঙ্গ, বিভক্তি, পুরুষ বা বচন ভেদে যেসকল পদের রূপের কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটে না, তাদের বলা হয় অব্যয় পদ। বাক্যের স্থান, কাল, পাত্রের সম্বন্ধ নির্দেশ করাই হল অব্যয়ের কাজ। আবার বাক্যের ভাবপ্রকাশও করে অব্যয়। অব্যয়কে এভাবে ভাগ করা যায়—
- সংস্কৃত বা তৎসম অব্যয় : অতএব, অতীব, অকস্মাৎ, অতঃপর, অথবা, অর্থাৎ, অদ্য, অধুনা, অন্যত্র, অবশ্য, অধিকন্তু, একত্র, একদা, কিংবা, কিঞিৎ, কিন্তু, কেবল, চমৎকার, তথা, তথাপি, তথৈব, তথৈবচ, ধিক্, নচেৎ, নতুবা, নানা, নিতান্ত, পরস্তু, পশ্চাৎ, পুনঃ, পৃথক, প্রতি, প্রভৃতি, পুনরায়, পুনশ্চ, প্রাক্, প্রাতঃ, প্রায়, ক্রমশ, বরং, বর, বা, বিনা, বৃথা, যত্র, যথা, যদি, যদ্যপি, যাবৎ, যুগপৎ, রে, সদা, সদ্য, সম্প্রতি, সম্যক, সর্বত্র, সহসা, সাক্ষাৎ, সুতরাং, স্বয়ং, যে। ইঃ, ইস্, উঃ, উহু, ওঃ, ওরে, ওলো, ও হরি, কি, কেন, কখন, তখন, তবু, তবেই, তারপর, তেমন, তো, তা, দূর, ধেৎ, ছি ছি, না, নাকি, বাঃ, বাপরে, বাপরে বাপ, বাহবা, বেশ, বুঝি, মরি মরি, মতো, মতন, যখন, শাবাশ, হায় হায়, হায়রে, বলিহারি।
- খাঁটি বাংলা অব্যয় : অথচ, আচ্ছা, আর, আবার, আ মরি, আ মরে যাই, আরে, আহা রে, মরি, বালাই ।
অব্যয়ের শ্রেণিবিভাগ
প্রয়োগ এবং অর্থপ্রকাশ বা বৈচিত্র্যের দিকে তাকিয়ে অব্যয়কে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা— (১) পদান্বয়ী অব্যয়, (২) সমুচ্চয়ী অব্যয়, (৩) অনন্বয়ী, এবং (৪) অনুকার অব্যয়।
অব্যয়ের শ্রেণিবিভাগ নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো —
পদান্বয়ী অব্যয়
যেসমস্ত অব্যয় বাক্যের বিভিন্ন পদের মধ্যে অন্বয় বা সম্বন্ধ স্থাপন করে তাদের পদান্বয়ী অব্যয় বলে। যেমন — ‘দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?’ ‘বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি। প্রথম বাক্যে ‘বিনা’-র পূর্ববর্তী ‘দুঃখ’ পদে কোনো বিভক্তি নেই, দ্বিতীয় বাক্যে ‘বাঘ’ শব্দে রস সঙ্গে ‘এর’ বিভক্তি চিহ্ন যুক্ত আছে। সুতরাং, পদান্বয়ী অব্যয়ের প্রয়োগ ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী পদে বিভক্তি চিহ্ন থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। তবে পদান্বয়ী অব্যয় বাক্যস্থ বিভিন্ন পদের মধ্যে অন্বয় বা সম্পর্ক স্থাপন করে। আরও দৃষ্টান্ত—সহিত, নিমিত্ত, জন্য, সহ, মত, মতন ইত্যাদি।
এই শ্রেণির অব্যয়কে প্রয়োগ অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—
- উপমাবাচক : মতো, মতন, যেন, যেমন, হেন, পারা, প্রায়, সম, তুল্য, ন্যায় ইত্যাদি।
- ব্যতীত অর্থবাচক : বিনা, ব্যতীত, ব্যতিরেক, ভিন্ন, ছাড়া, বই, বিহনে, বাদে ইত্যাদি।
- অনুসর্গরূপে প্রযুক্ত : সহিত, সঙ্গে, ওপরে, নীচে, সামনে, পাশে, ভিতরে, বাইরে, নিমিত্ত, তরে, জন্য ইত্যাদি।
সমুচ্চয়ী বা বাক্যান্বয়ী অব্যয়
যেসমস্ত অব্যয় একাধিক পদ বা একাধিক বাক্যের মধ্যে সংযোগ অথবা বিয়োগ সাধন করে তাদের সমুচ্চয়ী বা বাক্যাম্বয়ী অব্যয় বলে। অর্থ অনুযায়ী প্রয়োগ, সংযোজন অথবা বিয়োজনের নানা বৈশিষ্ট্য ধরে ব্যাকরণে সমুচ্চয়ী অব্যয়কে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন—
- সংযোজক: যেসব অব্যয় বিভিন্ন বাক্য, বাক্যাংশ বা পদের মধ্যে সংযোগ সাধন করে তাদের সংযোজক অব্যয় বলে। যেমন— ও, এবং, আরও, আর, তাই, অতএব ইত্যাদি। প্রয়োগ— তুমি আর আমি মিলে চাঁদের পাহাড়ে পৌঁছে যাব।
- বিয়োজক : যেসব অব্যয় বিভিন্ন বাক্য, বাক্যাংশ বা পদের মধ্যে বিয়োগ সাধন করে তাদের বিয়োজক অব্যয় বলে। যেমন— বা, অথবা, কিংবা, নতুবা, না, বিনা, হয় ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : সে কিংবা তুমি এই কাজটি করে দেবে।
- সংকোচক : যেসব অব্যয় বাক্যের অর্থকে সংকুচিত করে তাদের সংকোচক অব্যয় বলে। যেমন—কিন্তু, বরং, তবু, তথাপি, তবে, অথচ, পরন্তু ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : অনেক কাজ ছিল, অথচ তুমি এলে না।
- সংশয়বাচক : যেসব অব্যয় কোনো কাজের প্রতি সংশয় বা সন্দেহ প্রকাশ করে তাদের সংশয়বাচক অব্যয় বলে। যেমন-- তবে, নাকি, বুঝি, পাছে ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : তুমি নাকি ঝাড়খণ্ডে গিয়েছিলে।
- সিদ্ধান্তবাচক : যেসব অব্যয় পদের সাহায্যে সিদ্ধান্ত বোঝানো হয়, তাদের সিদ্ধান্তবাচক অব্যয় বলে। যেমন— অতএব, কাজেই, এজন্য, কাজে, তাই ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : সময় নেই, সুতরাং দেরি কোরো না।
- শর্তবাচক: যেসব অব্যয় পদের দ্বারা শর্ত প্রকাশ হয়ে থাকে তাদের শর্তবাচক অব্যয় বলে। বাক্যে প্রয়োগ: তুমি যদি ঠিক সময়ে যাও তবেই ওনার সঙ্গে দেখা হবে। আমি যেতে পারি কিন্তু তোমায় আসতে হবে।
- হেতুবাচক : যেসব অব্যয় পদ হেতু অর্থে ব্যবহৃত হয় তাদের হেতুবাচক অব্যয় বলে। যেমন— কারণ, যেহেতু, বলেই, কেননা ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : আমি অবশ্যই যাব, কেননা তোমার কাজ বলে কথা।
- অন্যথাসূচক বা ব্যতিরেকাত্মক : ঘটনা না ঘটবার সম্ভাবনা অনুমান করতে যেসমস্ত অব্যয় পদ ব্যবহৃত হয় তাদের অন্যথাসূচক বা ব্যতিরেকাত্মক অব্যয় পদ বলে। যেমন- যদি, নইলে, নচেৎ, নতুবা ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : ‘নতুবা দেখিতে তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।'
- নিত্যসম্বন্ধীয় : যেসমস্ত অব্যয় পদের মধ্যে পরস্পর পরিপূরক হয়ে দেখা যায়, তাদের নিত্যসম্বন্ধীয় অব্যয় পদ বলে। যেমন— যত-তত (যত মত তত পথ) যাব্র-তার (যাব্র জীবন তার থাক) যেমন-তেমন (যেমন কর্ম তেমন ফল), বরং-তবু (বরং গাছতলায় থাকব, তবু কারোর জমি দখল করব না) ইত্যাদি।
- উপমাদ্যোতক : যেসমস্ত অব্যয় পদ দ্বারা উপমা প্রকাশ করা হয় তাদের উপমাদ্যোতক অব্যয় পদ বলে। যেমন— যেন, মতন, ন্যায়, যেমন, যথা ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন তোমার মন।
স্বতন্ত্র অব্যয় : যে সমস্ত অব্যয় একাধিক পদ বা একাধিক বাক্যকে জুড়ে না দিয়ে বাক্যের মধ্যে স্বাধীনভাবে বসে ক্রিয়াটিকে নানাভাবে বিশেষিত বা নিয়ন্ত্রিত করে তাদের স্বতন্ত্র অব্যয় পদ বলে। প্রয়োগ এবং অর্থপ্রকাশের দিক থেকে এগুলোকে প্রধানত তিন ভাবে ভাগ করা হয়। যথা --
- প্রশ্নাত্মক : যেসমস্ত অব্যয় পদ দ্বারা ক্রিয়ার গুণ, অবস্থা বা প্রকৃতি বোঝা যায় তাদের প্রশ্নাত্মক অব্যয় পদ বলে। যেমন— কি, নাকি, তো, না যে, তাই, বটে, হ্যাঁ, আজ্ঞে, অ্যা ইত্যাদি।
- বাক্যালংকার : যেসমস্ত অব্যয় পদ বাক্যের অর্থ পরিবর্তন ঘটায় না কিন্তু বাক্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি জন্য ব্যবহৃত হয় তাদের বাক্যালংকার অব্যয় বলে। যেমন- ত (এত মেয়ে মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চ না (কত ‘না’ দিনের দেখা, কত 'না' রূপের মাঝে), গো, (মেয়ে আসবে ‘গো’ আসবে), কী (দেখুন ে ‘কী’ অশান্তি!) ইত্যাদি।
- নিষেধাত্মক : যে অব্যয় বারণ না মানা অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাকে নিষেধাত্মক অব্যয় বলে। যেমন না, নহে (বারবার বলছি, আগুন নিয়ে খেলা করবে না। তুমি যাবে না। অতো ভেবো না, যা হবার অ হবে।) ইত্যাদি।
অনন্বয়ী অব্যয় :যে সমস্ত অব্যয়ের সাহায্যে মনের উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা, ক্ষোভ, বিস্ময় বা কোনো বিশেষ ভাব প্রকাশ কর যায়, কিন্তু বাক্যের সঙ্গে সম্পর্ক বা অন্বয় অত্যন্ত দুর্বল তাদের অনন্বয়ী বা মনোভাববাচক অব্যয় বলে। যেমন— সাবাস, আচ্ছা, উঃ, বাঃ, ধিক্ ইত্যাদি। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রয়োগ এবং অর্থপ্রকাশের দিক থেকে অনন্বয়ী অব্যয়গুলোকে নানা পর্যায়ে ভাগ করেছেন। যেমন—
- সম্মতিজ্ঞাপক : যেসমস্ত অব্যয় পদ বাক্যে সম্মতি প্রকাশ করে, তাদের সম্মতিজ্ঞাপক অব্যয় বলে। যেমন— হাঁ হ্যাঁ, হুঁ, আচ্ছা, আজ্ঞে, যা বলেন ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : আচ্ছা, সে দেখা যাবে।
- অসম্মতিজ্ঞাপক : যেসমস্ত অব্যয় পদ বাক্যে অসম্মতি প্রকাশ করে, তাদের অসম্মতিজ্ঞাপক অব্যয়। বলে। যেমন— না, কখনো না, একদম না, আদৌ না, মোটেই না ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : একথা শুনব না।
- প্রশংসা বা অনুমোদনজ্ঞাপক : যেসব অব্যয় পদ বাক্যে অনুমোদন বা প্রশংসার পরিচয় বহন করে তাদের প্রশংসা বা অনুমোদনজ্ঞাপক অব্যয় বলে। যেমন- সাবাস, বেশ-বেশ, সাধু-সাধু, ধন্য, চমৎকার, হাসা ইত্যাদি। যেমন— তার কথা শুনে সবাই সাধু-সাধু বলে উঠলেন।
- ঘৃণা বা বিরক্তিব্যঞ্জক: যেসব অব্যয় পদ বাক্যে ঘৃণা বা বিরক্তি প্রকাশ করে তাদের ঘৃণা বা বিরক্তিব্যঞ্জক অব্যয় বলে। যেমন – ছিঃ, ছি-ছি, থুঃ, দুর-দুর, দুত্তোর, ধেৎ, কী মুস্কিল, কী জ্বালা ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ: ছিঃ। এ কাজ তোমার সাজে না।
- ভয় বা দুঃখসূচক : যেসমস্ত অব্যয় পদ দ্বারা বাক্যে ভয়, যন্ত্রণা বা দুঃখ প্রকাশিত হয় তাদের ভয় বা দুঃখ-সূচক অব্যয় বলে। যেমন— অ্যাঁ, ওরে বাবা, বাবা গো, ওহো, ওরে, ইস্ উঃ, মা, মা রে, মা গো, গেলাম রে, মরে গেলুম, হায় হায় ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : ইস্, তোমার এমনটি হবে আমি ভাবিনি।
- বিস্ময়দ্যোতক : যেসকল অব্যয় পদ বাক্যে বিস্ময় প্রকাশ করে, তাদের বিস্ময়দ্যোতক অব্যয় বলে। যেমন— আহা, এ কি, ও মা, বাপরে বাপ, ও বাবা, আঁ ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : আহা! কী চমৎকার রেজাল্ট করেছ।
- করুণাদ্যোতক : যেসমস্ত অব্যয় পদ বাক্যে করুণা প্রকাশ করে, তাদের করুণা-দ্যোতক অব্যয় বলে। যেমন— আহা, আহা-রে, বাছা আমার, মা আমার, ধন আমার, মানিক আমার সোনা আমার ইত্যাদি। বাকে প্রয়োগ : ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আহা কী চেহারা করেছিস।
- আহ্বান বা সম্বোধনদ্যোতক : যেসমস্ত অব্যয় পদ বাক্যে আহ্বান বা সম্বোধন অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাদের আহ্বান বা সম্বোধনদ্যোতক অব্যয় বলে। যেমন— এই, এই যে, ওগো, হ্যাঁ, হে অয়ি, আয়-আয়-আয়-আয় (বিভিন্ন প্রাণীকে আহ্বান করতে), চৈচৈ, তু-তু-তু-তু ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ : এই যে, তোমাকেই ডাকছিলাম।
- প্রশ্নবোধক : যেসমস্ত অব্যয় পদ প্রশ্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাদের প্রশ্নাত্মক অব্যয় পদ বলে। যেমন— অ্যাঁ ? তাই নাকি কি/কী ? বটে ? না ? হাঁ ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ: গতকাল কি তুমি গিয়ে ছিলে ?
0 Comments
Post a Comment