ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ
আমরা প্রতিদিন কত কথা বলে থাকি। সব কথা যে অর্থ জেনে বলি তা নয়। আমরা জানিই না আমাদের কথা বলার মধ্যে ধ্বনির কত বিচিত্র পরিবর্তন হয়ে থাকে। কেন এই পরিবর্তন? কীভাবেই বা এই পরিবর্তন হয় তা জানতে হয়। মূলত ধ্বনি পরিবর্তনের কতগুলি কারণ রয়েছে। পাহাড়ি এলাকার মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, জঙ্গল মহলের মানুষ সে ভাষায় কথা বলে না। বলাবাহুল্য সারা পৃথিবীতে ইংরেজরা ঔপনিবেশিক শক্তিতে অতি দ্রুত প্রভাব বিস্তার করেছিল। জার্মানরাও ক্ষমতার দম্ভে সবাইকে ভয় দেখিয়েছিল। ফলে জার্মানি ও ইংরেজি ভাষা বেশ কর্কশ। তুলনায় ফরাসি ভাষা বেশ মিষ্টি। অর্থাৎ ধ্বনি পরিবর্তনের নানা রকম কারণ থেকে যায়। শীতপ্রধান দেশের মানুষ আর গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ একভাবে কথা বলে না। মানুষ রেগে গেলে যেভাবে কথা বলে, গান গাইবার আগে সেভাবে কি কথা বলে? তোমাদের ক্লাসের বন্ধুরা সবাই কি একই ভাষায় কথা বলে? কারও ভাষা শুনতে খুব ভালো লাগে; মনে হয় কান পেতে আরও কিছুক্ষণ তার কথা শুনি। আবার কারও ভাষা এত কর্কশ যে, সে সামনে আসলে মনে হয় পালিয়ে যাই। ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিগুলি নিরন্তর পরিবর্তিত হয়।
ধ্বনির পরিবর্তনের কতকগুলি কারণ আছে। যেমন—
১] শারীরিক কারণ
১.১) বাগ্যন্ত্রের ত্রুটি : সবার ধ্বনি উচ্চারণ সমান নয়। তাই অনেকে ‘দুধ’কে ‘ডুড’ বলে। এমনকী
‘তামাক’কে ‘টামাক' বলতেও শোনা যায়।
১.২) শ্রবণযন্ত্রের ত্রুটি : শ্রবণযন্ত্রের ত্রুটির কারণে ধ্বনি উচ্চারণে সমস্যা হয়। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, কেউ বললেন, ‘একটু বসুন, কথা আছে।' কিন্তু যে কানেই কিছু শুনতে পায় না, সে কী কথা শুনবে। তাই তার কাছে ‘বসুন’ হয়ে যেতে পারে ‘একটু রসুন' (অপেক্ষা করুন।)
১.৩) অনুকরণের অক্ষমতা : অনেক সময় অন্যের ভাষা আমরা অন্ধের মতো অনুকরণ করতে যাই। কখনও ভুল ইংরেজিও বলে ফেলি। ফুটবলে তো ‘মেক্সিকো’কে অনেকে ‘মেস্কিকো’ বলে থাকেন। এভাবেই ‘স্টেশন হয়ে যায় ‘ইস্টিশান'।
১.৪) দ্রুত উচ্চারণ প্রবণতাজনিত ত্রুটি: উচ্চারণের ভুল থাকার কারণে কখনও ধ্বনির পরিবর্তন হয়। যেমন— 'বাতাসা' হয়ে যায় ‘বাসাতা। এভাবে ‘কোথা যাবে’ হয়ে যায় ‘কোজ্জাবে?? ১.৫) অবজ্ঞা/তুচ্ছার্থে শব্দের ব্যবহার : আমাদের প্রবণতাই হল সবসময় সংক্ষেপে বলা। আর এই কর্মটি করতে গিয়ে আমরা 'মধু'কে বলি ‘মোধো'। এভাবে ‘মদ্যপ’কে বলি ‘মোদো মাতাল'।
২] মানসিক কারণ:
২.১) উচ্চারণে অক্ষমতা : আমরা সবসময় ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারি না। এরফলে ধ্বনির পরিবর্তন হয়। যেমন— ব্যাছ > ব্যচ, ফর্ম > ফ্রম, উচ্চারণ > উশ্চারণ। এভাবেই আমরা ‘স্টাইল’কে বলি ‘ইস্টাইল।
(২.২) ভাবপ্রবণতা : অতিরিক্ত ভাবুকতা থেকে ধ্বনি পরিবর্তিত হয়। যেমন— প্রায় ক্ষেত্রে আমরা মামাকে বলি ‘মামু’। অনেকে আবার মাকে 'মামা' বলে থাকে।
২.৩) অন্যমনষ্কতা : আমরা কথা বলার সময় কখনও কখনও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। এর ফলে অনেক সময় ভুল উচ্চারণ করে থাকি। যেমন— 'কাক'কে বলে ফেলি 'কাগ'। অনেক সময় তাড়াতাড়ি কথা বলার ফলেই ‘শাক’কে ‘শাগ' কিংবা 'পাখি'কে ‘পাকি' বলে থাকি।
২.৪) সাদৃশ্য একটি শব্দের সাদৃশ্যে আর একটি শব্দ তৈরি করার একটি সহজাত প্রবণতা আমাদের মধ্যে দেখা যায়। যেমন— ‘দশ' শব্দের সাদৃশ্যে ‘একাদশ’, ‘দ্বাদশ’ ইত্যাদি বলে থাকি। ঠিক এভাবে ‘কালিদাস’ শব্দের সাদৃশ্যে 'কালিচরণ’, ‘কালিপদ' ইত্যাদি শব্দ বলে থাকি।
৩) ধ্বনি পরিবর্তনের বাহ্য কারণ
৩.১) ভৌগোলিক কারণ : উত্তরবঙ্গের মানুষ প্রকৃতির বুকে লালিত। অত্যন্ত শান্ত-শিষ্ট এসব মানুষজন যেভাবে কথা বলবেন, কলকাতার পরিবেশে থাকা মানুষরা সেভাবে কথা বলবেন না। একথা বলার কারণ,
ভৌগোলিক অঞ্চলের পার্থক্য থেকে মানুষের ভাষা বলার প্রকৃতিও বদলে যায়।
৩.২) ঐতিহাসিক কারণ : ভাষা বিবর্তিত হয়। এর ফলে পূর্বের অর্থ বর্তমানে বদলে যায়। যেমন ‘সিন্ধু' শব্দটি থেকে বর্তমানে ‘হিন্দু’ শব্দটি এসেছে। আবার একইভাবে 'ঘোটক' শব্দ থেকে এসেছে ‘ঘোড়া'। ৩.৩) সামাজিক কারণ : দেশে অশান্তি-অসন্তোষ থাকলেও অনেক সময় ভাষা বিবর্তিত হয়। তখন ভাষার গঠন হয় রুক্ষ ও কর্কশ।
৩.৪) লিপি বিভ্রাটের কারণ : কোনো ভাষার শব্দ অন্যভাষায় লেখার সময় লিপি বিভ্রাট হতে পারে। আর এভাবে ‘বসু' হয় 'বাসু', 'কলকাতা' হয় 'ক্যালকাটা'।
৩.৫) উপকরণগত : যে উপকরণে বস্তুটি নির্মিত হয় অনেক সময় তার বস্তুর নাম অপরিবর্তিত থাকে। যেমন – কালি বলতে আগে বোঝাত কালো উপকরণে গঠিত কালো রঙের তরল। বর্তমানে লাল, সবুজ প্রভৃতি উপকরণে গঠিত তরলকেও কালি বলা হয়।
ধ্বনি পরিবর্তনের তিনটি ধারা :
ক) ধ্বনি আগাম
খ) ধ্বনির লোপ
গ) ধ্বনি রূপান্তর
ধ্বনির আগমন:
ধ্বনির আগমন কে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা যায় । যথা : ১) স্বরাগম ও ২) ব্যঞ্জনাগম
স্বরাগম: শব্দের আদি, মধ্যে বা অন্তে সংযুক্ত ব্যঞ্জন থাকলে তার আগে, পরে বা মধ্যে একটি স্বরধ্বনির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে উচ্চারণ ক্রাশ করার প্রক্রিয়াকেই বলা যায় স্বরাগম।
স্বরাগম তিন প্রকার । যথা: ক) আদি স্বরাগম, খ) মধ্যস্বরাগম এবং গ) অন্ত্য স্বরাগম।
ক) আদি স্বরাগম: শব্দের শুরুতেই যুক্তব্যঞ্জন থাকলে উচ্চারণের সুবিধার্থে যুক্তব্যঞ্জন পূর্বে একটি সুবিধাজনক স্বরধ্বনির আগম ঘটে। একেই বলা হয় আদি-স্বরাগম। যেমন: স্পর্ধা> আস্পর্ধা, স্টেশন> ইস্টেশন ইত্যাদি।
খ) মধ্যস্বরাগম: শব্দের মধ্যে যুক্তব্যঞ্জন থাকলে উচ্চারণ প্রয়াস কমানোর খাতিরে, সরলীকরণের প্রয়াসে অথবা ছন্দের কারণে যুক্তব্যঞ্জন দুটির মধ্যে একটি স্বরধ্বনির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে শব্দের সৌকর্য বৃদ্ধির রীতিকে বলা যায় মধ্যস্বরাগম। যেমন: কর্ম>করম, নির্মল> নিরমল, বর্ষণ>বরিষণ, মুক্তা>মুকুতা, গ্রাম>গেরাম ইত্যাদি।
অন্ত্য স্বরাগম: শব্দের অন্তে যুক্ত ব্যঞ্জন থাকলে উচ্চারণের শ্রম কমাতে ও উচ্চারণের আড়ষ্টতাকে সহজ করার জন্য অতিরিক্ত যে স্বরধ্বনির আগম ঘটে, তাকে অন্ত্য-স্বরাগম বলা হয়। যেমন : দুষ্ট>দুষ্টু, নস্য>নস্যি, সত্য>সত্যি, বেঞ্চ>বেঞ্চি ইত্যাদি।
Next Part Coming Soon
0 Comments