Header Ads Widget

পদ পরিচয় | Part Of Speech | বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি



পদ পরিচয়

বাক্যের মধ্যে আমরা যেসব শব্দ ব্যবহার করি তার প্রতিটি হলো একটি পদ। এই পদ তৈরি হয় শব্দের সঙ্গে শব্দ বিভক্তি আর ধাতু বিভক্তি যুক্ত হয়ে। পদ হল শব্দের পরিবর্তিত একটি রূপ, যা দিয়ে আমরা বাক্য গঠন করি এবং মনের ভাবটিকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করি।
যেমন: অজয়ের মাথা ধরেছে।
এই বাক্যটিতে আমরা তিনটি পদের ব্যবহার লক্ষ্য করছি সে গুলি তৈরি হয়েছে এভাবে--
         শব্দ +   শব্দ বিভক্তি/ধাতু বিভক্তি     = পদ
         জয় +              এর                                 =জয়ের
        মাথা +              শূন্য                           =মাথা
         ধরা +        ইয়াছে/এছে                     =ধরেছে

এতক্ষণ দেখলে শব্দ বা ধাতুকে পদে পরিণত করতে বিভক্তি একান্ত প্রয়োজন ।

বিভক্তি: যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি শব্দ বা ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদ গঠন করে, সেই বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি কে বিভক্তি বলে। যেমন-- অ, কে, রে, এর,ইয়াছে ,ইলেন,ইতেছে প্রভৃতি ।

'বিভক্তি' দুই প্রকার- 'শব্দ বিভক্তি' ও 'ধাতু বিভক্তি' ।

শব্দ বিভক্তি: যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শব্দটিকে নাম পদে পরিণত করে এবং বাক্যে স্থান লাভ এর যোগ্যতা দেয়, সেই বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি কে শব্দ বিভক্তি বলে। যেমন-- অ,কে, রা ,এর, এ,তে এতে ইত্যাদি।

ধাতু বিভক্তি :- যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কার্য বাচক ক্রিয়াপদের সৃষ্টি করে, সেই বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি কে ধাতু বিভক্তি বলা হয়। যেমন-- অ, এ, এন, ই ,ইল, ইতেছি,ইয়াছেন ইত্যাদি।

পদের শ্রেণি বিভাগ

পদ প্রধাণতঃ দুই প্রকার - নামপদক্রিয়াপদ

নামপদ: শব্দের সঙ্গে শব্দ বিভক্তি যোগে গঠিত পদকে নামপদ বলে।
ক্রিয়াপদ: ধাতুর সঙ্গে ধাতু বিভক্তি যোগে যে কার্য বাচক পদের সৃষ্টি হয় তাকে ক্রিয়াপদ বলে ।

নামপদকে আবার চারটি ভাগে ভাগ করা হয় : বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ ও অব্যয় । অতএব পদ মোট- পাঁচ প্রকার ।

পদের শ্রেণিবিভাগ গুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো।



বিশেষ্য


                      গঙ্গা ভারতের দীর্ঘতম নদী।
                     গান্ধীজী হলেন জাতির জনক।

এই বাক্য দুটিতে 'গঙ্গা' ও 'গান্ধীজী' পথ দিয়ে দুুুটি বিশেষ নাম কে বুঝানো হয়েছে । এভাবে কোন পদ এর দ্বারা আমরা যদি কোন কিছুর নাম বোঝাতে চাই তাকেই বিশেষ্য পদ বলা হয়। অর্থাৎ যে শব্দে কোন ব্যাক্তি, বস্তু, স্থান, জাতি,গুন,ধর্ম, অবস্থা, কার্য ,সমষ্টি ইত্যাদির নাম বোঝায় তাকে বিশেষ্য পদ বলে। একে নাম বা নামপদ বলা হয়। যেমন--

         রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের দেশের গর্ব।
         গরু গৃহপালিত পশু।
        অজয় ভালো নাচতে পারে।
উপরের তিনটি বাক্যের স্থূলাক্ষর  পদগুলি হল বিশেষ্য পদ।

বিশেষ্য পদ কে আবার নানা শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো।

ব্যক্তি বা সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য: যে বিশেষ্য পদে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি, স্থান, দেশ, নদী ,পর্বত, সমুদ্র, গ্রন্থ, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বিশেষ নাম বোঝায় তাকে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন -- পৃথিবী, সূর্য ,বাংলা ,রামকৃষ্ণমিশন, বিবেকানন্দ, ভারত, দামোদর, কলকাতা, রামায়ণ, তাজমহল,হিমালয় ইত্যাদি।

জাতিবাচক বা শ্রেণী বাচক বিশেষ্য: যে বিশেষ্য পদে কোন ব্যক্তি বা এক ধর্ম বিশিষ্ট সকল ব্যক্তি বা বস্তু বা শ্রেণীকে বোঝায় তাকে জাতিবাচক বা শ্রেণিবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন--পশু,পাখি, গোরু, বৃক্ষ,হিন্দু, মুসলমান,কীটপতঙ্গ ইত্যাদি।

বস্তুবাচক বিশেষ্য:  যে বিশেষ্য পদে সাধারণভাবে কোনো জিনিসের নাম বোঝায় তাহাকে বস্তুবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন - জল, ফুল ,আকাশ, বাতাস সন্দেশ, টাকা, পয়সা, ঘটি ,বাটি ,খাট ,পালঙ্ক, সিমেন্ট,কাগজ,কলম ইত্যাদি
সাধারণত বস্তুবাচক বিশেষ্যর সংখ্যা গণনা সম্ভব নয় মেপে বা ওজন করিয়া পরিমাপ স্থির করতে হয়।

সমষ্টিবাচক বিশেষ্য: যে বিশেষ্য পদে কোন জাতিবাচক বিশেষ্যের সমষ্টি বোঝায় তাহাকে সমষ্টিবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন-- সমিতি,সভা, সংঘ, জনসংখ্যা, পঞ্চায়েত পাল ,গুচ্ছ ,বাহিনী, ত্রিফলা ,পঞ্চপট্টি দল ইত্যাদি।
সংখ্যাবাচক বিশেষ্য: এক,দুই,তিন প্রভৃতি সংখ্যাবাচক শব্দ গুলিকে বিশেষরূপে ব্যবহৃত হলে সংখ্যাবাচক বিশেষ্য বলা হয়। যেমন-- 'দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ', ' সাতেও নেই পাঁচেও নেই।'
গুণবাচক বিশেষ্য: যে বিশেষ্য পদের দ্বারা প্রাণীর বা বস্তুর দোষ,গুণ ,ধর্ম ,উৎপত্তি ইত্যাদি বোঝায় তাকে গুণবাচক বিশেষ্য বলে । যেমন-- গুণ, বুদ্ধি ,সৌন্দর্য, অহংকার, কুটিলতা ,মাধুর্য ,তিক্ততা, কামনা ,বাসনা করুনা,প্রতিভা ইত্যাদি।

অবস্থা বাচক বিশেষ্য : যে বিশেষ্য পদের দ্বারা প্রাণী বা বস্তুর অবস্থা বোঝায়,তাকে অবস্থা বাচক বিশেষ্য বলে। যেমন--  দুঃখ-কষ্ট , দারিদ্র্য, স্বাধীনতা, যন্ত্রণা ,রাত্রি, শান্তি ইত্যাদি।
ভাববাচক বিশেষ্য: যে বিশেষ্য পদের দ্বারা প্রাণীর মনের কোন বিশেষ ভাব বোঝায় তাকেই ভাববাচক বিশেষ্য বলে। যেমন-- ক্রোধ, আনন্দ-বেদনা, নৈরাশ্য, তৃপ্তি সুখ, হাসি ,উল্লাস, সমাধি ইত্যাদি
ক্রিয়া বাচক বিশেষ্য: যে বিশেষ্য পদের দ্বারা কোন কাজের নাম বোঝায়, তাকেই ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন-- ভজন ভোজন ,অধ্যাপনা দর্শন ,মরণ ,বাচন, খাওয়া ,ঘুম, লেখা,পড়া, লিখন ,ফোটন গমন, চলন ইত্যাদি।
  (আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় গুণবাচক, অবস্থাবাচক, ভাববাচক বিশেষ্য কে 'গুন' বা 'ভাববাচক' বিশেষ্য বলেছেন।)



 সর্বনাম

অঙ্কন  খুবই বুদ্ধিমান ছেলে।
অঙ্কন  প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যায়।
অঙ্কন প্রতিদিন মন দিয়ে পড়াশোনা করে।
এই জন্য অঙ্কন কে শিক্ষক/শিক্ষিকাগণ খুবই ভালোবাসে।
উপরের বাক্য চারটিতে বারবার অঙ্কনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে । এইভাবে নাম ব্যবহার না করে তার পরিবর্তে সে বা তাকে শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। এমন ব্যবহারে অর্থের পরিবর্তন ঘটে না, সেইসঙ্গে বাক্যগুলি শ্রুতি মধুর হয়। যেমন--
অঙ্কন  খুবই বুদ্ধিমান ছেলে।
সে  প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যায়।
সে প্রতিদিন মন দিয়ে পড়াশোনা করে।
এই জন্য তাকে  শিক্ষক/শিক্ষিকাগণ খুবই ভালোবাসে।
এইভাবে সাধারণত নামের বা বিশেষ্যের পরিবর্তে যে পদ আমরা বাক্যে ব্যবহার করি তাকে সর্বনাম পদ বলা হয়। । যেমন-- আমি, তুমি, সে, তাকে, ইনি, ওটা, যিনি, নিজ আপনি, উভয়, সকল ইত্যাদি।

সর্বনামের শ্রেণি বিভাগ

সর্বনাম পদ কে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।--
পুরুষবাচক বা ব্যক্তিবাচক সর্বনাম: যে সর্বনামে কোন ব্যক্তি কে বোঝায়, তাকে ব্যক্তিবাচক বা পুরুষ বাচক সর্বনাম বলা হয়। যেমন-- আমি, আমরা, আমাকে, আমাদের, তুমি, সে, তুই, তোকে, তারা, তিনি, তাহাদের, তার ইত্যাদি।

নির্দেশক বা সামীপ্যবোধক নির্দেশক সর্বনাম: যে সর্বনামে কোন ব্যক্তি বা বস্তু কে নির্দেশ করে, তাকে নির্দেশক বা সামীপ্যবাচক নির্দেশক সর্বনাম বলে। যেমন:- এ, এরা, ইহা, ইহারা, এই,এরা, একে, এটা, এগুলি, প্রভৃতি ।
অনির্দেশক সর্বনাম ‌: যে সর্বনামে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তু বা ভাবের পরিবর্তে বসে, তাকে  অনির্দেশক সর্বনাম পদ বলে । যেমন: কেহ, কেউ, কিছু, যে ,কেহ, কিছু-কিছু,আর, কেউ,  কেউ-কেউ, অমুক, কোনো কিছু ইত্যাদি।

প্রশ্নবাচক সর্বনাম: যে সর্বনাম পদে কোন কিছু জানবার ইচ্ছা থাকলে, তাকে প্রশ্ন বাচক সর্বনাম বলে। যেমন-- কে কী, কোনটা, কারা-কারা, কিসে, কে কে, কী কী, কোনগুলো, কোনগুলি ইত্যাদি।

সংযোগক সর্বনাম: যে সর্বনাম পদ দুই বা তার বেশি ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে সংযোগ বোঝায়, তাকে সংযোজক বা সম্বন্ধ বাচক সর্বনাম বলে। যেমন-- যে, যিনি, যা,যিনি-তিনি, যাকে-তাকে ইত্যাদি।

অন্যাদি বাচক সর্বনাম: অন্য, অপর, অমুক, স্বয়ং, আপনা-আপনি প্রভৃতি কয়েকটিকে অন্যাদিবাচক সর্বনাম বলে। 

সাকুল্যবাচক সর্বনাম: যে সর্বনাম পদ সমষ্টি বাচক ব্যক্তি বস্তু বা ভাবের পরিবর্তে প্রয়োগ করা হয়, তাকে সাকুল্যবাচক সর্বনাম বলে। যেমন-- সর্ব, সব, সকল, উভয়, সবাই, সবকিছু ইত্যাদি।

আত্মবাচক সর্বনাম: যে সর্বনামে কারো সাহায্য না নেওয়ার ভাবটি বিশেষ জোরের সঙ্গে বুঝানো হয়, তাকে আত্মবাচক সর্বনাম বলে। যেমন-- আপনি ,আপনারা, নিজেদের, আপন ইত্যাদি।

বিশেষণ

খোঁপায় বেঁধেছে হলুদ গাঁদার ফুল।

ওপরের বাক্যটিতে গাঁদা ফুলটির একটা বিশেষ গুণ উল্লেখিত হয়েছে। গুণটি হলো ‘হলুদ’ যা কিনা গাঁদা ফুলকে এক বিশিষ্ট পরিচয় দান করেছে। এইভাবে বাক্যে ব্যবহৃত যেপদ কোনো কিছুকে বিশিষ্ট করে তাকেই বলে বিশেষণ। বিশেষণ শুধু যে বিশেষ্যকেই বিশেষিত করে তা নয়, অন্যান্য অর্থাৎ সর্বনাম, ক্রিয়া ইত্যাদি পদকেও বিশেষিত করে।

বাংলা ভাষায় বহু ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ আমরা লক্ষ করি। যাকে আবার মূল চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যেমন—

বিশেষ্যের বিশেষণ পাকা বাড়ি। পোষা কুকুর। অনেক লোক। অল্প চুল। দু রাত। তিন বেলা। প্রথম শ্রেণি। বিংশ শতক। ধবধবে চাদর। ঝিরঝিরে বৃষ্টি।

সর্বনামের বিশেষণ : পন্ডিত তিনি। বোকা সে। বুদ্ধিমান তুমি। জ্ঞানী আপনি।

বিশেষণের বিশেষণ : খুব ভালো নাটক। কনকনে ঠান্ডা বাতাস। 

ক্রিয়া বিশেষণ : জোরে হাঁটো। এখানে আচ্ছি। ক্রমাগত চলছে। এখন এলাম।


ক্রিয়া

বরুণ ছবি আঁকছে

বাক্যটিতে ‘আঁকছে’ পদটি দ্বারা একটি কাজ করা বোঝাচ্ছে। এই বাক্যটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা এও দেখতে পাব যে, এখানে ‘বরুণ’ সম্বন্ধে কিছু বলা হচ্ছে। এইভাবে বাক্যে যার সম্বন্ধে কিছু বলা হয় সে হলো উদ্দেশ্য। আর এই উদ্দেশ্যের সম্বন্ধে যা বলা হয় তা হলো বিধেয়। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ‘বরুণ’ হচ্ছে কর্তা আর তার হওয়া বা কোনো কিছু করা যে শব্দ দ্বারা বোঝানো হলো তা হচ্ছে ক্রিয়া। যেহেতু এখানে ‘আঁকছে’ পদটি দিয়ে ‘বরুণ’-এর কোনো কাজ করা বোঝানো হয়েছে তাই এই পদটি হলো ক্রিয়া।

এই ক্রিয়া বাক্যের বিধেয় অংশে থাকে। যেমন—

 পাখি ওড়ে।     সূর্য ওঠে।           জল পড়ে

বাক্যগুলিতে বিধেয় অংশে থাকা ‘ওড়ে’, ‘ওঠে’, ‘পড়ে’-এই পদগুলি যথাক্রমে পাখি, সূর্য ও জলের কোনো কাজ করা বোঝাচ্ছে, তাই এরা একএকটি ক্রিয়াপদ।


ধন্যবাদ