‘মোটা মহিলা দুটি, যাঁদের মধ্যে একজনের নাম- ছেনুমাসি আর অন্যটির নাম বেণুমাসি, তাঁরা চোখ ড্যাবড্যাব করে বুকুর কথা শুনছিলেন। যাঁদের' ও 'তাঁরা' ‘মহিলা দুটি' বিশেষ্য পদের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। পদ দুটি সর্বনাম। কাজেই, বিশেষ্য পদের পরিবর্তে যে পদ ব্যবহৃত হয়, তাকে বলা হয় সর্বনাম পদ (Pronoun)|
‘সর্বনাম' শব্দের অর্থ সকল নাম। সবরকম নামের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় বলে ‘সর্বনাম' বলা হয়।
লক্ষণীয় সর্বনাম কেবল পদের পরিবর্তেই বসে না, বাক্য বা বাক্যাংশের পরিবর্তেও বসে। যেমন—'রাজা, ঐ বালক ঋষিকুমার নহে, ইহা অবগত হইয়া, তাপসীকে জিজ্ঞাসিলেন।' 'ঐ বালক ঋষিকুমার নহে' এই বাক্যাংশের পরিবর্তে স্থূলাক্ষর ‘ইহা' ব্যবহৃত হয়েছে। সর্বনাম পদ একই শব্দের পুনরুল্লেখ দূর করে ভাষাকে শ্রুতিমধুর ও প্রাঞ্জল করে। যেমন—প্রথম দৃষ্টান্তের ‘মহিলা দুটি' বারবার ব্যবহার না করে ‘যাঁদের’, ‘তাঁরা' পদ ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে ভাষার মাধুর্য ও প্রাঞ্জলতা বেড়েছে।
সংস্কৃত সর্বনাম পদ থেকে বহু বাংলা সর্বনাম পদের উৎপত্তি। ব্যক্তিবাচক, সম্বন্ধবাচক, আত্মবাচক, সমষ্টিবাচক, প্রশ্নবোধক, নির্দেশক প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার বাংলা সর্বনামের সকল দৃষ্টান্ত, তাদের অধিকাংশের উদ্ভব সংস্কৃত সর্বনাম থেকে। এদের সম্ভ্রমার্থক ও তুচ্ছার্থক রূপও লক্ষণীয়।
* বিভিন্ন প্রকার সর্বনাম: বাংলায় সর্বনাম পদ বহু প্রকার। যেমন—
(ক) ব্যক্তিবাচক: যে সর্বনাম পদের দ্বারা ব্যক্তি বা পুরুষকে বোঝানো হয়, তাকে ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক সর্বনাম (Personal Pronoun) বলে। যেমন: সে, তাহার (তার), তাহাকে (তাকে), তিনি, তাঁহার (তাঁর), তাঁহাকে (তাঁকে), তাহারা (তারা), তাহাদের (তাদের), তাহাদিগকে, তাঁহারা (তাঁরা), তুমি, তোমাকে, তোমার, তোমরা, আপনি, আপনাকে, তুই, আমি, আমাকে, আমার, আমরা, মোর, মোরা, মুই ইত্যাদি। প্রতিটি পদই ব্যক্তিবাচক সর্বনাম।
পুরুষভেদে ব্যক্তিবাচক সর্বনাম পদ হয় তিন প্রকারের। যথা—
(১) উত্তম পুরুষের সর্বনাম: 'আমা সবা ছাড়ি কোথা যাইবে, রাজন।' 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।' 'মুই সেলাম করে বললাম।' বাক্যগুলিতে 'আমি', 'মোর', 'আমার', 'আমরা', 'আমাকে', ‘মম', ‘আমা’, ‘মুই' ইত্যাদি সর্বনাম পদগুলির দ্বারা বক্তা নিজেকে বুঝিয়েছে, কাজেই সর্বনামগুলি উত্তম পুরুষের সর্বনাম (First Person) | মোরা, মোকে, মোর, মোদের, মম প্রভৃতি কেবল কবিতাতে ব্যবহৃত হয়।
(২) মধ্যম পুরুষের সর্বনাম: 'তুমি', ‘তোমার', 'তুই', ‘তব’, ‘তোর', ‘তোমায়' সর্বনাম পদগুলির দ্বারা যার সঙ্গে কথা বলা হয়, তাকে বোঝানো হয়েছে। কাজেই, ওই সর্বনাম পদগুলি মধ্যম পুরুষের সর্বনাম (Second Person) |
আপনি, আপনাকে, আপনার প্রভৃতি সর্বনাম কেবল সম্মাননীয় ব্যক্তির পরিবর্তে বসে। তুই, তোর, তোকে, তোরা, তোদের প্রভৃতি বসে আদর কিংবা অবজ্ঞার পাত্র, এমন ব্যক্তির পরিবর্তে। তব, তোমা প্রভৃতি কবিতায় ব্যবহৃত হয়।
(৩) প্রথম পুরুষের সর্বনাম: উত্তম ও মধ্যম পুরুষ বাদে যা কিছু, সবই প্রথম পুরুষের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম পুরুষ বোঝাতে যে সর্বনাম পদ ব্যবহৃত হয়, তাকে বলা হয় প্রথম পুরুষের সর্বনাম (Third Person)। যেমন—সে, তাহাকে (তাকে), তাহার (তার), তাহারা (তারা), তাহাদের (তাদের), যাঁহাদের (যাঁদের), তাহাদিগকে (তাদেরকে), তাঁহার (তাঁর), তাঁহারা (তারা), তিনি, উনি, ইনি, ওঁর, ওঁরা, এঁর, এঁরা, উহারা (ওরা), উহারা (ওঁরা) ইত্যাদি।
(খ) সম্বন্ধবাচক বা সংযোগমূলক: 'যে-সব সর্বনাম পদগুলি দুই বা তার বেশি ব্যক্তির সম্বন্ধ বা সংযোগ বুঝিয়েছে। বস্তুর ক্ষেত্রেও এরকম সম্বন্ধ বা সংযোগ বোঝানো হয়। কাজেই, দুই বা তার বেশি বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে সম্বন্ধ বা সংযোগ বোঝায়, এমন সর্বনাম পদকে বলা হয় সম্বন্ধবাচক বা সংযোগমূলক সর্বনাম (Relative Pronoun)। যেমন—যাহারা (যারা), যাহা (যা), যাঁহারা (যাঁরা), যাঁহাকে (যাঁকে), যে, যিনি, যেটি, যেটা, যেগুলি, যেসব, যেসমস্ত ইত্যাদি। যিনি, যাঁহার (যাঁর), যাঁহারা (যাঁরা), যাঁহাকে (যাঁকে) প্রভৃতি সম্ভ্রমার্থে ও যাহা (যা), যেটি, যেটা, যেগুলি প্রভৃতি বস্তু ও নিকৃষ্ট প্রাণীর সম্পর্কে ব্যবহার করা হয়।
(গ) আত্মবাচক : নিজস্ব বা আত্মভাব প্রকাশক সর্বনামকে বলা হয় আত্মবাচক সর্বনাম (Reflexive Pronoun)। এরকম সর্বনাম প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো উদ্দেশ্যসাধনে কারোর সাহায্য না নিয়ে নিজের ওপর পুরোপুরি জোর দেওয়া হয়। যেমন—স্বয়ং (স্বয়ম্), আপনি, নিজ, নিজে-নিজে, নিজ-নিজ, নিজেকে, নিজেরে ইত্যাদি।
(ঘ) সাপেক্ষ বাচক সর্বনাম : যে সর্বনাম পদগুলি একটির সাপেক্ষে আর একটি ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ বাক্যের মধ্যে একটিকে ব্যবহার করলে অপরটিকেও ব্যবহার করতে হয়, তাদের সাপেক্ষ সর্বনাম বলে। যেমন: যে-সে। যে সয়, সে রয়।
(ঙ) নির্দেশক : কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে যে সর্বনাম পদের দ্বারা নির্দেশ করা হয়, তাকে বলা হয়। নির্দেশক বা নির্ণয়সূচক বা উল্লেখসূচক সর্বনাম (Demonstrative Pronoun)। যথা—ইহা (এ), ইহারা (এরা), ইহারা (এঁরা), এই, ঐ, এটা, ওটা, ইনি, উনি, উহা (ও), এগুলা, এগুলো, এগুলি, উহারা (ওঁরা), উহারা (ওরা), ওই ইত্যাদি। একের বেশি ব্যক্তি বা বস্তুকে পৃথক করে নির্দেশ করতে এই প্রকার সর্বনামের দ্বিত্ব হয়। যথা—এই এই, এটা এটা, ঐ ঐ, ওটা ওটা ইত্যাদি।
নির্দেশক সর্বনাম দু-প্রকার। যথা—
(১) প্রত্যক্ষ নির্দেশক : নিকটস্থ কোনো ব্যক্তি বা বস্তু-নির্দেশক সর্বনামকে বলা হয় প্রত্যক্ষ নির্দেশক সর্বনাম (Near Demonstrative Pronoun)। যথা—এই, ইহা (এ), ইহারা (এরা), ইঁহারা (এঁরা), এটা, ইনি, এগুলো, এগুলি ইত্যাদি।
(২) পরোক্ষ নির্দেশক : যে সর্বনাম পদের দ্বারা দূরবর্তী কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করা হয়, তাকে বলে পরোক্ষ নির্দেশক সর্বনাম (Far Demonstrative Pronoun)। যথা- ঐ, ওটা, উনি, সে, সেই, উহা (ও), ওগুলো, ওগুলি, উহারা (ওঁরা), উহারা (ওরা) ইত্যাদি।
ঊনি, উহারা (এঁরা) প্রভৃতি সম্মানের বা সৌজন্যের ক্ষেত্রে এবং অবশিষ্টগুলি প্রাণী বা অপ্রাণীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
(চ) প্রশ্নবোধক : কোনো কিছু জানার ইচ্ছা যে সর্বনাম পদের দ্বারা প্রকাশ করা হয়, তাকে বলা হয় প্রশ্নবোধক সর্বনাম (Interrogative Pronoun)। যেমন—কে, কাহার (কার), কাহারা (কারা), কাঁহারা (কারা), কাঁহার (কাঁর), কাহাকে (কাকে), কি, কোটা, কোনটি, কি-সব, কোন্খানা, কোনগুলি ইত্যাদি।
একের বেশি ব্যক্তি বা বস্তুকে পৃথক করে বোঝাতে প্রশ্নবোধক সর্বনামেরও দ্বিত্ব ব্যবহৃত হয়। যথা—কি কী, কোন কোন, কে কে ইত্যাদি। 'ছেলেদের মধ্যে কে কে শ্রেণিকক্ষে হাজির ছিল ? কোন্ কোন বই তোমার পছন্দ?
লক্ষণীয় 'কি', 'কী' -এর বিভিন্ন পদরূপে ব্যবহার : (১) মেলায় আপনারা কি দেখলেন (প্রশ্নবোধক সর্বনাম) ? (২) ‘এ দিকে কী ইস্টিশান' (বিশেষণ)? (৩) স্রোতের কী প্রবল জোর (বিশেষণের বিশেষণ)। (৪) কী প্রচণ্ড বেগে ছুটছে গাড়ি (ক্রিয়াবিশেষণের বিশেষণ)। (৫) আকাশভরা জ্যোৎস্না দেখেছেন কি (প্রশ্নবোধক অব্যয়)।
(ছ) অনির্দেশক : অনির্দিষ্ট বস্তু, ব্যক্তি বা ভাব বোঝাতে যে সর্বনাম ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় অনির্দেশক সর্বনাম (Indefinite Pronoun)। যথা—কেই (কেউ), কাহারও (কারো), কাহারাও (কারাও) ইত্যাদি।
** অনির্দেশক সর্বনাম সময় সময় বিশেষণ, সর্বনাম বা অব্যয় পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যৌগিক বা মিশ্র অনির্দেশক সর্বনাম গঠন করে। যেমন-আর-কেহ (আর-কেউ), অন্য-কেহ (অন্য-কেউ), কেহ-কেহ (কেউ-কেউ), অপর-কেহ (অপর-কেউ), অন্য কিছু, কিছু-না-কিছু যাহা-কিছু (যা-কিছু), কেহ-না-কেহ (কেউ-না-কেউ), কেহ-বা (কেউ-বা), যে-সে, যে-কেহ (যে-কেউ) প্রভৃতি।
(জ) ব্যতিহারিক: অপরের সাহায্য ছাড়া স্বেচ্ছায় বা পারস্পরিক সম্বন্ধ বোঝাতে যে সর্বনাম ব্যবহৃত হয়, তাকে বলা হয় ব্যতিহারিক বা পারস্পরিক সর্বনাম (Reciprocal Pronoun)| যথা—আপনা-আপনি, নিজে-নিজে ইত্যাদি।
(ঝ) সাকল্যবাচক : বস্তু, ব্যক্তি বা ভাবের সমষ্টির পরিবর্তে ব্যবহৃত সর্বনামকে বলা হয় সাকল্যবাচক সর্বনাম। যথা—সকল, সর্ব, সবাই (সব্বাই), সবে, সবার, উভয় ইত্যাদি।
** বিশেষণ ও ক্রিয়াবিশেষণ রূপে : পরিমাণ, স্থান, কাল ও সাদৃশ্য বোঝাতে সর্বনামের মূল অংশের উত্তর বিভিন্ন প্রত্যয় যোগে বিশেষণ ও ক্রিয়াবিশেষণ গঠিত হয়। যথা—
(ক) পরিমাণবাচক : এত (এ-ত), যত (য-ত), তত (ত-ত), কত (ক-ত) প্রভৃতি।
(খ) স্থানবাচক : যেখান (যে-খান), যেখানে (যে-খানে), সেখান (সে-খান), সেখানে (সে-খানে), কোথায় (কো-থায়), কোথাও (কো-থাও), এখান (এ-খান), হেথা (হে-থা), হোথায় (হো-থায়), যেথায় (যে-খায়) প্রভৃতি। প্রয়োগ—তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ। ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়।
(গ) কালবাচক : এখন (এখন), তখন (তখন), তখনো (তখনো), যখন (যখন), কখন (কখন), কখনো (কখনও) ইত্যাদি। প্রয়োগ—কুঞ্জে তখনো গ্রহণ করেনি কেহই অন্নজল।’‘এখন শুভ্র শরৎকাল।' ‘নতুন ছিলে যখন তুমি।' 'কখন মরণ আসে কে বা জানে।'
(ঘ) সাদৃশ্যবাচক : যেমন (যে-মন), যেমত (যে-মত), তেমন (তে-মন), এমন (এ-মন), এমত (এ-মত), কেমন (কে-মন), অমন (অ-মন) ইত্যাদি। প্রয়োগ—যেমন কর্ম তেমন ফল। ‘রঘুনাথ এমত চিন্তিয়া মনে মনে।”
THANKS
0 Comments
Post a Comment